গণশত্রু - সত্যের মোড়কে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার গল্প
❝মানুষের জন্য ধর্ম নাকি ধর্মের জন্য মানুষ?❞
অশোক গুপ্ত, একজন সৎ ও নির্ভিক ডাক্তার। হঠাৎ তার জন্ডিসের রোগী অনেক বেশি হওয়ায় তিনি চিন্তিত হয়ে যান এবং এর কারণ খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন৷ তিনি চন্ডিপুর শহরের কিছু জায়গার জল কলকাতায় পাঠিয়ে দেন পরীক্ষা করার জন্য। পরীক্ষার ফল হাতে আসার তিনি দেখেন যে, তার ধারণাই ঠিক! উনি রোগীর আধিক্যের স্থান বিশ্লেষণ অনুমান করে করে যে জায়গার কথা ভেবেছিলেন ঠিক সেই জায়গার জলেই পাওয়া গেছে জন্ডিসের বীজাণু! উনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই ব্যাপারে পুরো শহরকে সতর্ক করতে হবে খুব দ্রুত নাহলে এটা মহামারিতে রূপ নেবে!
এবার ঘটনায় একটু প্যাঁচ লাগলো কারণ, যে স্থানের জলে জন্ডিসের বীজাণু পাওয়া গেছে সেখানেই অবস্থিত ত্রিপুরেশ্বরের মন্দির। এই মন্দিরই ঐ এলাকার মূল বিন্দু, এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভীড় হয়, বাহির থেকেও ট্যুরিস্ট আসে। পুরো এলাকায় আর টিউবওয়েল না থাকায় এলাকার সবাই এই মন্দির থেকেই জল নিয়ে ব্যবহার করে। তাই, এখানে স্পষ্ট যে সমস্যা সেই মন্দিরের জল থেকেই ছড়াচ্ছে, যা আসে মিউনিসিপ্যালটির লাইন থেকে। হয়তো মিউনিসিপালিটির অদক্ষতা এবং দূর্নীতির কারণে নিম্নমানের কাজ হওয়ায় মাটির নিচে কোথাও খাবার জলের পাইপ আর নর্দমার জলের পাইপ ফেঁটে মিশে যাওয়ায় এমন হচ্ছে। তাই, এই অবস্থায় করণীয় হলো মন্দির কিছুদিনের জন্য বন্ধ রেখে জলের লাইনের সমস্যা খুঁজে ঠিক করা!
কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে আছে কিছু দূর্নীতিবাজ। এই মন্দির বিখ্যাত, তাই এখানে ট্যুরিস্ট আসে প্রচুর, সংগ্রহ হয় অনেক টাকা। সেই টাকার একটা মোটা অংশ যায় ঐ সব দূর্নীতিবাজ নেতাদের পকেটে। তারমধ্যে সমস্যা দেখা দেয়ার কিছুদিন পর আবার মন্দিরে বড় কোনো উৎসব আছে কয়েকদিন ব্যাপি, সেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আসে, ইনকামও প্রচুর হয়। এরমধ্যে এই রোগের খবর কাগজে ছাপলে তো বাহির থেকে কেউই আসবে না! তাই এই খবর কী ছাপতে দেবে তারা? সামান্য ডাক্তারের কী ক্ষমতা আছে এই খবর ছাপানোর??
এদের কথা হলো ঐ এলাকার জলে জন্ডিসের বীজাণু থাকতে পারে কিন্তু মন্দিরের জল, চরণামৃত(Holy Water) শুদ্ধ, এতে কিছুতেই বীজাণু থাকতে পারে না, এখান থেকে রোগ ছড়াচ্ছে না। কারণ, এই চরণামৃতে আছে দুধ, তিল, বেলপাতা, তুলসী পাতা। তুলসি পাতা থাকায় নাকি এর সব জীবাণু ধ্বংস হয়ে গেছে, শুদ্ধ হয়ে গেছে!
আরও দেখুন: পাবলিকিয়ান ডটকম
এটা ঐসব দূর্নীতিবাজদের লজিক। এ লজিক ডাক্তারকে দিলে হবে না, যারা বোঝে তারাও মানবে না। কিন্তু তারা যদি এই লজিক দিয়ে আমজনতাকে উষ্কে দেয় ডাক্তারের বিরুদ্ধে? আমাদের আমজনতা কী করবে? তারা কী এতকিছু চিন্তা করে? তারা তো চলে আবেগে!
এখন, সেই মন্দির বন্ধ করবে কীভাবে? কাদেরকে বোঝাবে? "মন্দির বন্ধ" করতে চাওয়া কী সামান্য কোনো কথা? আমাদের উপমহাদেশের ধর্মপ্রাণ(অন্ধ) লোকজন তা মানবে?
এই কারণে ডাক্তার অশোক গুপ্ত হয়ে গেলেন আমজনতার শত্রু, ❝গণশত্রু❞!
এতদূর পড়ে মনে হতে পারে পুরো সিনেমার গল্পই হয়তো বলে দিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কিছুই বলি নি! আরও অনেক অনেক ঘটনা-উত্তেজনা আছে সিনেমায়।
সিনেমাটি ভারতের, তাই ভারতের প্রধান ধর্ম নিয়েই গল্পটা সাজানো। কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখুন তো এমন মানুষজন কী সবজায়গাতেই আছে না? ২০২০-২০২১ এর করোনার প্রকোপ চলাকালীন সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই এমন ঘটনার বাস্তব রূপ দেখা গেছে! এখনো না দেখে থাকলে কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত "গণশত্রু" সিনেমাটি দেখে নিতে ভুলবেন না।